শুভ আঢ্য
উও লম্হা গুজর হি তো গ্যয়া...
শুভ আঢ্য
দৃশ্য – ১ চ্যাপলিনের মর্ডান টাইমস। এক বিশাল মেশিনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে একজন। তার হাতে মাত্র সামান্য প্লায়ার্স। এক বিশাল সমুদ্র যেন, যেখানে লোহা ঠেকে রয়েছে লোহায়, আকরিক ঠেকে রয়েছে আকরিকে এবং শিল্প জন্মাচ্ছে, নিষেক হচ্ছে তার। গর্ভে ভরে উঠছে এক পেট আর সেখানে কবিতা জন্মাচ্ছে, অক্ষর থেকে শব্দ জন্মাচ্ছে, শব্দ জন্ম দিচ্ছে ভাষার, লিপির গুম হয়ে যাওয়া থেকে টান উঠে আসছে শব্দের। মলিকিউলার ব্যাপার কোনো যা থেকে ফাইনাল প্রোডাক্ট হচ্ছে, কিন্তু ফাইনানশিয়াল নয়। দীপঙ্কর দা’র কবিতার কথা ভাবতেই এমন একটা ছবির কথাই মাথায় এল। কতটা প্রাসঙ্গিক জানি না, তা’ও এল।
দৃশ্য – ২ সালভাদোর দালির ছবি। চারটে বিচ্ছিন্ন প্রেমের ফুল, যাকে অনেকে আমরা ডেকে থাকি গোলাপ বলে, সেরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে, তার মূল থেকে, সোর্স থেকে; বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে অপরের থেকেও একে। তাদের মধ্য দিয়ে ভাবনারা ছুটোছুটি করছে, অথচ আমরা তার বিচ্ছিন্নতা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না, আমরা তার সৌন্দর্য নিয়েও যে ভাবছি খুব নয় তেমনও, কিন্তু চোখ আমাদের রাখতে হচ্ছে ওই বিচ্ছিন্নতার ওপর অথবা তার মধ্যে স্পেস যতটুকু ছেড়ে রাখা হয়েছে সেখানে এক তেজী দৃষ্টি হচ্ছে আঁকতে, এমনকী কোনো এক গড়িয়ে যাওয়া রক্ত আমাদের দৃষ্টিপথে টেনশন দিচ্ছে। অপ্রাসঙ্গিক এই রকম একটা ছবিও দীপঙ্করদা’র কবিতার কথা ভাবতে গিয়ে মাথায় এল।
আসলে কবিতা একটা বিক্রিয়া মাত্র, শব্দ আর পাংচুয়েশন একটা প্রকাণ্ড বীকারে ভুড়ুভুড়ি কাটছে। কেমিস্ট্রি ল্যাবে যেমন একটা বীকার থেকে ধোঁয়া বেরোয়, অপরটা থেকে নীল বা কুকুরের ঘা’য়ের মত রঙের তরল (গোলাপী এতটাই নরম এক ফিলিং আনে তা না লেখাই ভালো অথবা কোনো ফিলিংই আনে না) বা হাভানা চুরুট ধরানোর সময় যে পরিমাণ আগুন লাগে (প্রয়োজন নয়, লাগে... এতটুকুও কি লাগে না আগুন যেখানে পিটুইটারি নেই, ফ্রন্টাল, অক্সিপেটাল লোব নেই, অথচ যা কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়ায়) তেমন এক কেমিস্ট্রি ল্যাবের কথা এড়িয়ে গিয়ে দীপঙ্করদা’র কবিতা নিয়ে লেখা মুশকিল আমার পক্ষে।
অথচ আমার কর্নিয়া কোনোদিন দীপঙ্করদা’র ছায়া বা ছবি তোলেনি, কিছু জড় অবস্থায় আলোর প্রতিফলনে যা কিছু দেখা দীপঙ্করদা’কে, তার চেয়ে বেশী করে পাবার সুযোগ ঘটেনি। এই ২০১৭-র শীত আগুন পুড়িয়ে ফেলল আগুনকেই, শীত আর দূর হল না। দেখা হবার কথা নিয়ে এই জানুয়ারি টার্নিং থেকে অপর টার্নিং... একটা লোক আসার আগে যার ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম, মিথেন গ্যাসের মত উদ্বায়ী... সেই লোকটাই। অথচ তাঁর শব্দের ধারে মরচে পড়ে না।
গ্রীন সিগন্যাল যে সময়ে দেখতে পাওয়া যেত, অস্তিত্ব বাজত তখন হঠাৎই একদিন কথা বলে ফেললাম। শুরুতে খুব বেশী কিছু জেনে যে ওঁর সাথে কথা বলেছি নয় এমনটাও, এখনও জানার পরিধি একটাই সাদা কাগজে ধরে যায়। ওঁর সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখতাম একটা কারখানা মালিক কি করে তাঁর কারখানার প্রতিটা ব্যাপার পকেটে পুরে রাখেন, আগাছা পর্যন্ত নজর এড়ায় না তাঁর। আসলে আমার কাছে ওঁর লেখা কারখানা তো বটেই। যেখানে ওয়াগান বানানো হচ্ছে শব্দ থেকে তৈরী হচ্ছে ছাঁচ ও মুখের জিওগ্রাফি এবং তিনি তা লিখে রাখছেন মাথায়, তাঁর সামনে চচ্চড়ে রোদে শুকোচ্ছে অক্ষরেরা, আর যতি চিহ্নেরা। উনি দেখছেন। চিন্তা তৈরী হচ্ছে, ধোঁয়ার মত। চিন্তার খোলস একটু পরেই হয়তো বা ছেড়ে রেখে অক্ষরেরা শব্দ আর শব্দেরা অ্যামালগ্যামেট করে কবিতা হয়ে উঠবে। ওই বীকার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটাবে বিস্ফোরণ, আর, সেই ইন্টিগ্রেশন, ডিফারেন্সিয়েট করে আমার মুখ চেপে ধরবে, শ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে পড়লে বলতে যাবো, “ছোটো ছোটো শ্বাস পাগল করে দিল” এ তো আমার কথাই, কিন্তু জিভ তা বলে উঠবে না। জাস্ট এক্ষুনি মনে হচ্ছে নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতার কোনো বইয়ের ব্লার্বে পড়েছিলাম –
“মুখে মেখের রুমাল বাঁধা, হাতে রিভলবার
আকাশের কাউন্টারে চাঁদকে বসিয়ে রেখে আমি সব তারা লুট করতে চাই”
এতটাই শ্বাসরোধী, অন্তত আমার কাছে, তবে যার কাছে শ্বাস বন্ধ রেখে ডুবুরি হতে ইচ্ছে হয়।
দীপঙ্করদা’র সাথে অতি অল্পদিনের পরিচিতি। যতটা তাঁর লেখার সাথে, ব্যক্তি মানুষের সাথে সময়কালের নিরিখে তার চেয়েও কম। প্রথম কিছুদিনের আলাপেই উনি পড়তে দিয়েছিলেন দীপঙ্কর দত্তের কবিতা। তার পর থেকে কিছুদিন ওঁর সাথে কি কথা বলব, ভেবে উঠতে সময় নিয়েছিলাম অনেক। আসলে বুঝতে পারছিলাম একজন মানুষ আমাকে ন্যাংটো করে আমার ছায়ার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, অথচ আমি ছায়ার দিকে চাইতে পারছি না, চাইতে পারছি না চামড়া আমার, অথচ পিছনে সূর্য বর্শার মত তাক করে আছে, এবং সেই লোকটিই রেখেছেন। এমন লেখা থেকে খুব পালাতে চেয়েছিলাম, কারণ বোধবুদ্ধি (খুব যে আছে তার দাবি করছি না, তবে ওই যে ক’ছটাক) যতটুকু আছে সব লোপ পেতে বসেছিল। দেখতে পাচ্ছিলাম ওই শক্তিশালী শব্দব্যাঙ্ক আমার ওপর আছড়ে পড়ছে। পরে দীপঙ্করদা’র থেকে বুঝে নিয়েছি অনেক সময়।
আসলে ওঁর লেখা এরকমই। প্রথম ‘শহর’ ম্যাগাজিনে ওঁর লেখা পড়ে কিছুটা মানসিক সন্তুলন খুইয়ে বসেছিলাম, তার পর ফ্রেণ্ড রিকুয়েস্ট পাঠাই। সামান্য কথা বাড়তে বাড়তে কি করে এই আনকোরা আমায় এতটা সময় দিতেন মাঝে মাঝে অবাকই লাগত। দেখতাম, ওঁর লেখা নিয়ে যত না বলেন, তাঁর চেয়েও অন্য লেখা নিয়ে, তার আঙ্গিক নিয়ে কথা বলতেন অনেক, অনেক... বলতেন কিভাবে ওঁর লেখায় শব্দকে শব থেকে তুলে এনে বসান কবিতায়। এমন শব্দ ব্যবহার, শুধু প্রান্তিক স্টেশনেরও নন যেমন তিনি, ততটাই কর্পোরেট, আর তাঁর মিক্সচার তো সুভান আল্লাহ্। কবিতার শুধু দেহ না, তার ত্বকের ভেতরের মেলানিন, তার ভেতরের মাংস, মজ্জা, অস্থি, তার ল্যাটারাল কোল্যাটারাল ভিউ পরতে পরতে খুলে উঠত... ওঁর লেখার সেই প্রতিটা শব্দ দেখে ওঁকে ভাস্করও বলা কি যায় না!
“বেশ্যার ক্ষুদে বাচ্চারা
আংকল মাম্মি বুলারহি হ্যায়
আংকল মেরি মাম্মি বুলারহি হ্যায়
আংকল ঝুট উসকি নহি, মেরি মাম্মি
দাঁড়া জল দে, অ্যাভোমিন গিলেনি একটা”
একটা শব্দের গায়ে আরেকটা শব্দ ঠিক ক’টা ওঠালে একের ছায়া অপরের ওপর পড়ে আর তা প্রকৃত ছায়া-ছবি হয়ে ওঠে তা ওঁর লেখায় কুঁদে কুঁদে আছে। আর সেই পেনিট্রেশন... উফ্, শব্দকে অণু করে তাকে ইনজেক্ট করে গ্রে-ম্যাটারে চালান করার এক চোরাচালানকারীর নাম দীপঙ্কর দত্ত। ওঁর কবিতার কাছে পিছমোড়া করে দাঁড়াতে হয় আমাকে, উনি লেখেন না, জাস্ট ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে সামান্য মস্করা, পিঠে হাত, লাস্ট ডিসায়ার... তারপর বুলেট... প্রোথিত করে দেন মগজে, অথচ কোনো রক্ত পড়ে না, অথচ কোনো শব্দ হয় না, গান উনি দু’অর্থেই ব্যবহার করেন লেখায়, আর দেখি দীপঙ্করদা’কে লাস্ট সাপারের ছবির মতোও লাগে। দীপঙ্করদা এমনই।
দীপঙ্কর দত্তের কবিতা বইতে এমনই এক লেখা
“ ঘটনাটা এই যে আমি
যতবার বোঝাতে চেয়েছি যে আপৎকালে
ওসব মায়া-ফায়া দ্বিধা, ঢ্যামনামো
ছেড়ে দিয়ে যা ভাঙার তা দ্রুত ভেঙে ফেলতে হয়
ততবারই তাদের হো হো আর হি হি আর
আব্বে চুপ!”
এর পর কি’ই বা লেখা যায়... তেমন আপৎকাল তিনিই তৈরী করেন, আর ভূত আর ওঝা, এসব ক্ষেত্রে এসেই থাকে। বেশ কিছু জিনিসের জন্য ঋণ থেকে তো গেছেই, ছুরি নিয়ে কি করে একটার পর একটা মাংস সাজাতে হয় এবং তা বড়ি হয়ে ওঠে তা ওঁর থেকেই শেখার চেষ্টা করতাম, না করি... লেখাগুলো থেকে গেল শুধু।
আমার লেখা পাঠালে পড়ে মতামত জানাতেন, এক লেখায় যেমন বলেছিলেন সত্তর বা ষাটের গন্ধ বেরোচ্ছে এবং তা যথেষ্ট ন্যাপথলিন দিয়েও চাপা যাচ্ছে না, তেমন কিছু লেখায় উৎসাহ জানিয়েছেন। আসলে হঠাৎ করেই শূন্যকালে লেখার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ফাটিয়ে লেখো, খুলে লেখো... কোনো প্রিকনসিভড্ আইডিয়া নয়, নিজের ডানা ছড়ানোর জন্য স্পেস দিতেন খুব। আর ওঁর শূন্যকাল ওয়েবজিনে পাঠানো ‘কবিকণ্ঠ’ বিভাগে আমার মত না-চিজকে কে’ই বা সুযোগ দিত আর... এটা সত্যিই খুব বড় একটা প্রাপ্তি। সময় অসময়ে যে ওঁর থেকে কিছু সাজেশন পেয়েছি লেখা সংক্রান্ত ও কোনো বড় ঘটনা ঘটলে তার খবর, তেমনই কখনও কখনও কোনো ভালো সিনেমার কথা বলেছেন, তার দৃশ্যের কথা বলেছেন আর দেখেছি, আমার মাথার মধ্যে নিড়েন চলছে, মাটির মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে নাইট্রোজেন। বুঝতে পারতাম কিভাবে লেখার সরঞ্জাম বিষয় সংগ্রহ করতে হয়, কিভাবে তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে পারে সেই সালভাদোর দালির কোনো বিচ্ছিন্ন ফুল তার উৎস থেকে অথচ উৎসকে অস্বীকার করে নয়, তাকে রেখেই তার মাঝের স্পেসটাকে কি করে বাড়াতে হয়... কি করে দু লাইনের মধ্যেও একটা শূন্যতাকে ধরতে হয় আর একটা ওয়ান অ্যাণ্ড অনলি ওয়ান ওয়ার্ডও কি করে গোটা একটা ভূগোল বা তার ইতিহাসকে ধরে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট।
"এতদ্বারা সর্বসাধারণকে জানানো যাইতেছে যে দক্ষিণ কেপ ভের দের পশ্চিম-দক্ষিণপশ্চিমের ট্রপিক্যাল নিকোলাস তিন দিন ধরিয়া উত্তরপশ্চিমে 80KT অতঃপর সাফির সিম্পসন স্কেলে উত্তরে 17-12-1996 তারিখে ননকনভেকটিভ রেমন্যান্ট লো বারমুডার 505 n mi পূর্ব-দক্ষিণপূর্বে এক্সট্রা ট্রপিক্যাল হইয়াছে।"
একটু পরেই ফেসবুকে অন হবে আমি, টাইমলাইন থেকে একটার পর একটা মুখ সরাতে সরাতে হঠাত জানতে পারব দিল্লি থেকে চলে গিয়েছে উষ্ণতা, জানুয়ারির এই শীতে তার আগুন জ্বলছে না আর, স্যাঁতস্যাঁতে কাঠে কিছুতেই ধরছে না দেশলাই, বরফ আসছে, দেখা যাচ্ছে না গ্রীন সিগন্যাল ট্রেন লেট, এবং রাস্তা দিয়ে শব্দ পার হচ্ছে, ধাক্কা মারছে মগজে, পাগল করে দিচ্ছে প্রতিটা অক্ষর তার জেট গতি নিয়ে, আর সেইসব অচেনা শব্দ যারা হয়তো কোনোদিন আর কবিতার সাথে সঙ্গম করবে না। ধুলো বাড়ছে, কষ্টও... । পেনের নিবও উঠছে না আর, তা’ও অর্ধনমিত।

পাঠকের মতামতঃ